আচ্ছা, আপনার আদরের বিড়ালছানাটা কি ইদানিং একটু নিস্তেজ হয়ে পড়েছে? খাবার খাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু শরীরে যেন তেমন বৃদ্ধি নেই? কিংবা পেটের গন্ডোগোল লেগেই আছে? তাহলে একটু মন দিয়ে লক্ষ্য করুন, হয়তো আপনার বিড়ালটি কৃমির দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে।
বিড়ালের কৃমি একটি অতি পরিচিত সমস্যা, তবে সময় মতো এর চিকিৎসা না করালে এটি মারাত্মক রূপ নিতে পারে। তাই, একজন সচেতন বিড়ালপ্রেমী হিসেবে, বিড়ালের কৃমি সম্পর্কে আপনার সম্যক ধারণা থাকাটা খুবই জরুরি।
এই ব্লগ পোস্টে, আমরা বিড়ালের কৃমি হলে করনীয় কি তা নিয়ে আলোচনা করবো, যাতে আপনি আপনার প্রিয় বিড়ালটিকে সুস্থ ও সুরক্ষিত রাখতে পারেন।
বিড়ালের কৃমি কেন হয়?
বিড়ালের কৃমি হওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। এদের মধ্যে কয়েকটি প্রধান কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
সংক্রমণের উৎস | বিবরণ |
সংক্রমিত মাটি বা মল | কৃমির ডিম বা লার্ভা মিশ্রিত মাটি বা মলের সংস্পর্শে এলে বিড়াল সংক্রমিত হতে পারে। |
সংক্রমিত শিকার | ইঁদুর, পাখি বা অন্যান্য ছোট প্রাণী শিকার করে খেলে কৃমি সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে। |
মায়ের দুধ | মায়ের শরীরে কৃমি থাকলে দুধের মাধ্যমে বাচ্চা বিড়ালও সংক্রমিত হতে পারে। |
ফ্লিস (মাছি) | ফ্লিস (fleas) কৃমির ডিম বহন করতে পারে এবং বিড়ালের শরীরে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। |
বিড়ালের কৃমি: প্রকারভেদ ও লক্ষণ
বিড়ালের কৃমি সাধারণত বেশ কিছু ধরনের হয়ে থাকে। যার মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ কয়েকটি হলো:
- গোলকৃমি (Roundworms)
- ফিতাকৃমি (Tapeworms)
- হুকওয়ার্ম (Hookworms)
- হৃৎকৃমি (Heartworms)
তবে এটা বোঝার রয়েছে যে, বিভিন্ন কৃমির সংক্রমণের লক্ষণ গুলো ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। নিচে কয়েকটি সাধারণ লক্ষণ উল্লেখ করা হলো:
বিড়ালের কৃমির লক্ষণ
লক্ষণ | বর্ণনা |
ওজন কমে যাওয়া | কৃমি শরীরে বাসা বাঁধলে বিড়ালের স্বাভাবিক ওজন কমতে শুরু করে। |
পেটের সমস্যা | বমি, ডায়রিয়া অথবা কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। |
দুর্বলতা | বিড়াল দুর্বল ও নিস্তেজ হয়ে যেতে পারে। |
পেট ফোলা | পেটে কৃমি থাকলে পেট ফুলে যেতে পারে, বিশেষ করে পেটের দিকে স্পর্শ করলে বিড়াল ব্যথা অনুভব করতে পারে। |
মলদ্বারে অস্বস্তি | কৃমি মলদ্বারের আশেপাশে চুলকানি সৃষ্টি করে, যার কারণে বিড়াল মেঝেতে বা অন্য কোনো কিছুর সাথে ঘষাঘষি করতে পারে। |
কাশ বা শ্বাসকষ্ট | হৃৎকৃমি সংক্রমণ হলে কাশি বা শ্বাসকষ্ট হতে পারে। |
মল-এ কৃমি | তবে অনেক সময় মলের সাথে কৃমি দেখা যেতে পারে। |
- কিভাবে বুঝবেন আপনার বিড়ালের কৃমি সংক্রমণ হয়েছে কিনা?
বিড়ালের শরীরে কৃমি আছে কিনা, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য কিছু বিষয় লক্ষ্য রাখতে পারেন। যেমন: আপনার পশু চিকিৎসক মলের নমুনা পরীক্ষা করে কৃমির উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারবেন। এটি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায়। তবে অনেক ক্ষেত্রেই এটা সম্ভব হয় না। তাই উপরের উল্লেখ্যিত লক্ষণ গুলো দেখা দিলেই বুঝে যাবেন আপনার বিড়ালের কৃমি হয়েছে।
বিড়ালের কৃমি হলে করনীয়
যদি আপনার বিড়ালের কৃমি সংক্রমণ ধরা পড়ে, তবে দ্রুত এর চিকিৎসা শুরু করা উচিত। নিচে কিছু করণীয় বিষয় আলোচনা করা হলো:
- পশুচিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া
প্রথমেই একজন পশুচিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন। তিনি আপনার বিড়ালের জন্য সঠিক ওষুধ এবং চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করবেন। নিজে থেকে কোনো ওষুধ দেবেন না, কারণ ভুল ওষুধ ব্যবহার করলে বিড়ালের স্বাস্থ্যের আরও অবনতি হতে পারে।
বিড়ালের কৃমির ঔষধ
পশুচিকিৎসক সাধারণত কৃমিনাশক ওষুধ (dewormer) দিয়ে থাকেন। এই ওষুধ গুলো কৃমি মারতে বা শরীর থেকে বের করে দিতে সাহায্য করে। কৃমিনাশক ওষুধ বিভিন্ন রূপে পাওয়া যায়, যেমন:
- ট্যাবলেট
- সিরাপ
- ইনজেকশন
পশুচিকিৎসক আপনার বিড়ালের জন্য যা উপযুক্ত মনে করেন, সেই অনুযায়ী ওষুধ দেবেন।
বিড়ালের কৃমির ঔষধ নাম
বাজারে বিভিন্ন ধরনের কৃমিনাশক ওষুধ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে কয়েকটি জনপ্রিয় ওষুধ হলো:
১) পাইরেন্টেল প্যামোয়েট (Pyrantel Pamoate): এটি গোলকৃমি এবং হুকওয়ার্মের জন্য ব্যবহার করা হয়।
২) প্রেজিকুয়েন্টেল (Praziquantel): এটি ফিতাকৃমির জন্য খুবই কার্যকরী।
৩) মিলবেমাইসিন অক্সিম (Milbemycin Oxime): এটি হৃৎকৃমি প্রতিরোধের জন্য ব্যবহৃত হয়।
৪) বিড়ালের কৃমির সিরাপ: ছোট বিড়াল ছানাদের জন্য সিরাপ ব্যবহার করা হয়, কারণ এটি খাওয়ানো সহজ। সিরাপের মধ্যে পাইরেন্টেল প্যামোয়েট খুবই জনপ্রিয়।
বিড়ালের কৃমির ওষুধ খাওয়ার নিয়ম
সাধারণত বিড়ালের কৃমির ওষুধ পশু চিকিৎসকের দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী ওষুধ খাওয়াতে হয়। কেননা, এতে ডোজ এবং সময়সূচী সঠিকভাবে মেনে চলতে হয়। তবে কিছু নিয়ম আছে যা সকলের ক্ষেত্রেই একই, যেমন:
- ট্যাবলেট: ট্যাবলেট সরাসরি মুখ দিয়ে বা খাবারের সাথে মিশিয়ে দিতে পারেন।
- সিরাপ: সিরিঞ্জ দিয়ে মেপে মুখের ভেতরে দিন।
- ইনজেকশন: এটি সাধারণত পশুচিকিৎসক দিয়ে থাকেন।
বিড়ালের কৃমি দূর করার উপায়
কথায় আছে, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ সবসময়ই ভালো। তাই, বিড়ালকে কৃমি থেকে বাঁচাতে কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত:
- নিয়মিত কৃমিনাশক ওষুধ: পশুচিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়ান।
- পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা: আপনার বিড়ালের পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন।
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: বছরে অন্তত একবার পশুচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান।
- কাঁচা মাংস পরিহার: বিড়ালকে কাঁচা মাংস বা মাছ খেতে দেবেন না।
বিড়ালের কৃমি দূর করার ঘরোয়া উপায়
- কাঁচা রসুন
রসুনে অ্যান্টিপ্যারাসাইটিক গুণ রয়েছে, যা কৃমি দূর করতে সাহায্য করতে পারে। একটি ছোট কোয়া রসুন কুচি করে বিড়ালের খাবারের সাথে মিশিয়ে দিন। তবে অতিরিক্ত রসুন দেওয়া এড়িয়ে চলুন, কারণ এটি বিড়ালের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। সপ্তাহে একবার বা দুবার এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে।
- কুমড়োর বীজ
কুমড়োর বীজে থাকা কিউকারবিটাসিন নামক যৌগ কৃমির বিরুদ্ধে কার্যকর। কুমড়োর বীজ শুকিয়ে গুঁড়ো করে বিড়ালের খাবারের সাথে মিশিয়ে দিন। এটি টেপওয়ার্ম এবং রাউন্ডওয়ার্মের মতো কৃমি দূর করতে সাহায্য করে।
- নিম পাতা
নিম পাতায় অ্যান্টিপ্যারাসাইটিক এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণ রয়েছে। নিম পাতা সিদ্ধ করে সেই পানি ঠান্ডা করে বিড়ালের পানিতে মিশিয়ে দিন। এটি কৃমি দূর করতে সাহায্য করবে। তবে নিমের তেল সরাসরি ব্যবহার করা এড়িয়ে চলুন, কারণ এটি বিষাক্ত হতে পারে।
- আপেল সিডার ভিনেগার
আপেল সিডার ভিনেগার শরীরের pH মাত্রা পরিবর্তন করে কৃমির বৃদ্ধি রোধ করতে পারে। বিড়ালের পানির বাটিতে এক চা চামচ আপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে দিন। এটি সপ্তাহে কয়েকবার দেওয়া যেতে পারে।
- হলুদ
হলুদে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টিপ্যারাসাইটিক গুণ রয়েছে। এক চিমটি হলুদ গুঁড়ো বিড়ালের খাবারের সাথে মিশিয়ে দিন। এটি কৃমি দূর করতে এবং বিড়ালের ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।
- নারকেল তেল
নারকেল তেলে লরিক অ্যাসিড রয়েছে, যা কৃমির বিরুদ্ধে কার্যকর। বিড়ালের খাবারের সাথে এক চা চামচ নারকেল তেল মিশিয়ে দিন। এটি সপ্তাহে কয়েকবার দেওয়া যেতে পারে।
- কাঁচা পেঁপে
কাঁচা পেঁপেতে থাকা পাপেইন নামক এনজাইম কৃমি দূর করতে সাহায্য করে। পাকা পেপায়ের একটি ছোট টুকরো বিড়ালের খাবারের সাথে মিশিয়ে দিন। এটি হালকা কৃমি সংক্রমণের জন্য কার্যকর।
বিড়ালের কৃমি সংক্রমণ হলে ঘরবাড়ি এবং বিড়ালের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ভালোভাবে পরিষ্কার করুন। যেমন: liter box প্রতিদিন পরিষ্কার করুন এবং জীবাণুনাশক দিয়ে ধুয়ে দিন। বিছানা ও খেলনা গুলো গরম পানি দিয়ে ধুয়ে দিন। মেঝে নিয়মিত ভ্যাকুয়াম করুন এবং জীবাণুনাশক ব্যবহার করুন।
কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
এখানে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো, যা বিড়ালের কৃমি নিয়ে আপনার মনে প্রায়ই আসতে পারে:
- বিড়ালের কৃমি দেখতে কেমন?
বিভিন্ন ধরণের কৃমি বিভিন্ন রকম দেখতে হয়। গোলকৃমি লম্বা এবং নলের মতো, দেখতে অনেকটা স্প্যাগেটির মতো। ফিতাকৃমি লম্বা এবং চ্যাপ্টা ফিতার মতো, যা ছোট ছোট খণ্ডে বিভক্ত থাকে। হুকওয়ার্ম ছোট এবং খুব সরু হয়।
- বিড়ালের কৃমির ছবি
- বিড়ালের কৃমির ট্যাবলেট এর নাম
বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির কৃমির ট্যাবলেট পাওয়া যায়। যেমন: ড্রন্টাল (Drontal), ক্যানিকিউর (Canicure), এবং প্রাজিকুয়েন্টেল (Praziquantel)। আপনার বিড়ালের জন্য কোন ট্যাবলেটটি উপযুক্ত, তা পশুচিকিৎসকই ভালো বলতে পারবেন।
- বিড়ালের কৃমিনাশক ওষুধ কতদিন পর পর দিতে হয়?
এটি নির্ভর করে আপনার বিড়ালের বয়স, স্বাস্থ্য এবং জীবনযাত্রার ওপর। সাধারণত, ছোট বিড়ালছানাদের প্রতি ২-৩ সপ্তাহে এবং বড় বিড়ালদের প্রতি ৩-৬ মাসে কৃমিনাশক ওষুধ দেওয়া উচিত। তবে, সঠিক সময়সূচী জানার জন্য পশুচিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
- মানুষের শরীরে কি বিড়ালের কৃমি ছড়াতে পারে?
কিছু ক্ষেত্রে, বিড়ালের কৃমি মানুষের শরীরেও ছড়াতে পারে। বিশেষ করে ছোট বাচ্চা এবং দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। তাই, বিড়ালের সংস্পর্শে আসার পর ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিন এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকুন।
চূড়ান্ত মন্তব্য
বিড়ালের কৃমি একটি সাধারণ সমস্যা হলেও, সময় মতো সঠিক চিকিৎসা না করালে এটি মারাত্মক হতে পারে। তাই, আপনার বিড়ালের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হন এবং উপরে দেওয়া পরামর্শগুলো মেনে চলুন। আপনার আদরের বিড়ালটি সুস্থ থাকুক, এটাই আমাদের কামনা।
যদি আপনার বিড়াল কৃমির দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখায়, তাহলে দেরি না করে একজন পশুচিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন। আপনার সচেতনতাই পারে আপনার বিড়ালকে সুস্থ ও আনন্দিত রাখতে।