বিড়াল! এই আদুরে প্রাণীটি আমাদের অনেকেরই খুব প্রিয়। এদের নরম তুলতুলে শরীর, মায়াবী চাহনি আর মজার কাণ্ডকারখানা মন জয় করে নেয়। কিন্তু এই নিরীহ প্রাণীটিও তো অসুস্থ হতে পারে, তাই না? মানুষের মতো বিড়ালেরও ফ্লু হতে পারে, যা “ফেলিন ইনফ্লুয়েঞ্জা” নামে পরিচিত।
সত্যি বলতে বিড়ালের ফ্লু কিন্তু প্রাণঘাতী, তবে একটুখানি সচেতন হলেই কিন্তু আপনার প্রিয় বিড়ালটিকে এই কষ্টদায়ক রোগ থেকে বাঁচাতে পারেন। এই কাজে সাহায্য করতে আজকে আমরা আলোচনা করবো বিড়ালের ফ্লু এর লক্ষণ ও কারণ গুলো নিয়ে। পাশাপাশি জানতে পারবেন আপনার বিড়ালের ফ্লু হলে আপনি কী করতে পারেন। তাহলে চলুন, শুরু করা যাক!
বিড়ালের ফ্লু কি ও কেনো হয়?
বিড়ালের ফ্লু (যা ফেলিন ইনফ্লুয়েঞ্জা নামেও পরিচিত) মূলত কয়েকটি ভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে। এর মধ্যে প্রধান হলো ফেলিন হারপিস ভাইরাস (FHV-1) এবং ফেলিন ক্যালিসি ভাইরাস (FCV)।
এই ভাইরাস গুলো বিড়ালের শ্বাসতন্ত্রের ওপর আক্রমণ করে, অনেকটা মানুষের ফ্লুয়ের মতো। বিড়ালের ফ্লু হওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকটি প্রধান কারণ হলো:
- ভাইরাস সংক্রমণ
ফেলিন হারপিস ভাইরাস (FHV-1) এবং ফেলিন ক্যালিসি ভাইরাস (FCV) প্রধানত দায়ী। এছাড়াও, * Bordetella bronchiseptica* এবং Chlamydophila felis নামক ব্যাকটেরিয়াও এই রোগের কারণ হতে পারে।
- সংক্রামিত বিড়ালের সংস্পর্শ
যদি আপনার বিড়াল অন্য কোনো ফ্লু-আক্রান্ত বিড়ালের সংস্পর্শে আসে, তাহলে তারও এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে ভাইরাস ছড়াতে পারে।
- দূষিত পরিবেশ
নোংরা বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ভাইরাস দ্রুত ছড়ায়। অপরিষ্কার লিটার বক্স, দূষিত খাবার এবং জলের পাত্র থেকেও সংক্রমণ হতে পারে।
- দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
কম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন বিড়াল, যেমন ছোট বিড়ালের বাচ্চা অথবা বয়স্ক বিড়াল, খুব সহজেই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
- স্ট্রেস অনুভব
অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা স্ট্রেস রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, ফলে বিড়াল ফ্লুয়ের শিকার হতে পারে। নতুন পরিবেশে আনা অথবা অন্য কোনো কারণে বিড়াল মানসিক চাপে ভুগলে ফ্লু হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
বিড়ালের ফ্লু এর লক্ষণ
বিড়ালের ফ্লু হলে আপনি কিছু সাধারণ লক্ষণ দেখতে পাবেন। এই লক্ষণ গুলো দেখা গেলে দ্রুত পশুচিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এই পর্যায়ে বিড়ালের ফ্লু এর লক্ষণ সম্পর্কে জানাবো।
- প্রধান কিছু লক্ষণ
বিড়ালের শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকতে পারে (সাধারণত ১০০.৫-১০২.৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। বিড়ালের ঘন ঘন হাঁচি বা কাশি দিবে এবং বিড়ালের চোখ ও নাক থেকে অনবরত পানি ঝরতে থাকবে।
বিড়াল খুব দুর্বল হয়ে যেতে পারে এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে অনীহা দেখাতে পারে। খাবারের প্রতি বিড়ালের আগ্রহ কমে যাবে বা একেবারে খাবার খাবে না।
গলার মধ্যে ব্যথা হবে, বিড়াল খাবার গিলতে বা পানি পান করতে অসুবিধা বোধ করবে। মুখের ভেতরে বা জিভে ছোট ছোট ঘা হতে পারে, যা খাবার খেতে সমস্যা সৃষ্টি করে। কিছু ক্ষেত্রে বিড়ালের শ্বাস নিতে কষ্ট হতে পারে, যা গুরুতর সমস্যার ইঙ্গিত দেয়।
- বিড়ালের বাচ্চার ফ্লু এর লক্ষণ
বিড়ালের বাচ্চাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় তারা খুব সহজেই ফ্লুতে আক্রান্ত হতে পারে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে কিছু অতিরিক্ত লক্ষণ দেখা যেতে পারে, যেমন:
ছোট বাচ্চাদের শ্বাস নিতে বেশি কষ্ট হতে পারে। ফ্লুয়ের কারণে বাচ্চাদের ডায়রিয়া হতে পারে, যা তাদের শরীরকে আরও দুর্বল করে দেয়। বমি বা ডায়রিয়ার কারণে শরীরে জলের অভাব দেখা দিতে পারে। তাছাড়া ফ্লুয়ের কারণে খাবার না খেতে পারলে দ্রুত ওজন কমতে শুরু করে।
- বিড়ালের চোখ ওঠা
ফ্লুয়ের কারণে বিড়ালের চোখ ওঠা একটি সাধারণ সমস্যা। একে কনজাংটিভাইটিসও বলা হয়। এর লক্ষণ গুলো হলো: চোখের সাদা অংশ লাল হয়ে যায়। চোখ থেকে অনবরত পানি পড়তে থাকে। বিড়াল আলোতে তাকাতে সমস্যা বোধ করে এবং চোখ কুঁচকে রাখে। চোখের চারপাশে ময়লা জমতে দেখা যায়।
বিড়ালের ফ্লু হলে করণীয়
বিড়ালের ফ্লু হলে দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, যাতে আপনার বিড়াল দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে আপনার করণীয় লিস্টে যা থাকবে:
প্রথমত, বিড়ালের ফ্লুয়ের লক্ষণ দেখা গেলে দ্রুত পশুচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। সঠিক রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য এটি খুবই জরুরি। এরপর বিড়ালকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দিন। একটি শান্ত এবং আরামদায়ক জায়গায় তাকে থাকতে দিন, যেখানে সে কোনো রকম disturbance ছাড়া বিশ্রাম নিতে পারে।
তাছাড়া শরীরকে হাইড্রেড রাখা খুবই জরুরি। বিড়ালকে সবসময় পরিষ্কার পানি দেয়ার ব্যবস্থা করুন। যদি সে নিজে থেকে পানি পান করতে না চায়, তাহলে সিরিঞ্জ দিয়ে অল্প অল্প করে খাওয়ান। গলা ব্যথা বা মুখের ঘা থাকলে বিড়ালের শক্ত খাবার গিলতে কষ্ট হতে পারে। তাই তাকে নরম খাবার দিন, যেমন ভেজা খাবার বা হালকা গরম করা খাবার।
বিড়াল পরিষ্কার ঘর বেশ পছন্দ করে, তাই বিড়ালের থাকার জায়গাটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন। নিয়মিত লিটার বক্স পরিষ্কার করুন এবং জীবাণুনাশক ব্যবহার করে ঘর মুছুন। যদি আপনার একাধিক বিড়াল থাকে, তাহলে অসুস্থ বিড়ালটিকে সুস্থ বিড়ালগুলো থেকে আলাদা রাখুন, যাতে সংক্রমণ ছড়াতে না পারে।
বিড়ালের যত্নে নরম কাপড় বা কটন বল হালকা গরম পানিতে ভিজিয়ে বিড়ালের চোখ ও নাকের জমাট বাঁধা ময়লা আলতো করে পরিষ্কার করুন। তাছাড়া ঠান্ডা থেকে বাঁচাতে ঘর সামান্য গরম রাখুন। তবে অতিরিক্ত গরম যেন না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। সবশেষে জ্বর কমাতে হালকা ভেজা তোয়ালে দিয়ে বিড়ালের শরীর মুছে দিন।
বিড়ালের ফ্লুয়ের জন্য ঔষধ
বিড়ালের ফ্লুয়ের জন্য কিছু নির্দিষ্ট ঔষধ পশুচিকিৎসক দিয়ে থাকেন। নিজে থেকে কোনো ঔষধ না দেওয়াই ভালো। সাধারণত যে ঔষধগুলো ব্যবহার করা হয়, সেগুলো হলো:
- অ্যান্টিভাইরাল ঔষধ: ভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে এই ঔষধ ব্যবহার করা হয়।
- অ্যান্টিবায়োটিক: যদি ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ থাকে, তাহলে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়।
- ব্যথানাশক: ব্যথা কমাতে এবং জ্বর নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যথানাশক ঔষধ ব্যবহার করা যেতে পারে।
- স্যালাইন: ডিহাইড্রেশন হলে শরীরে জলের অভাব পূরণের জন্য স্যালাইন দেওয়া হয়।
বিড়ালের ঘরোয়া চিকিৎসা
পশুচিকিৎসকের পরামর্শের পাশাপাশি আপনি কিছু ঘরোয়া পদ্ধতিও অনুসরণ করতে পারেন, যা বিড়ালের দ্রুত সুস্থ হতে সাহায্য করবে:
যেমন গরম জলের ভাপ নিলে বিড়ালের বন্ধ নাক খুলতে পারে এবং শ্বাস নিতে সুবিধা হয়। তাছাড়া তুলসী পাতা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। কয়েকটি তুলসী পাতা গরম জলে ফুটিয়ে সেই জল ঠান্ডা করে বিড়ালকে খাওয়াতে পারেন।
অন্যদিকে মধুর মধ্যে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান থাকে, যা গলা ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। অল্প পরিমাণে মধু বিড়ালকে সরাসরি অথবা জলের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে পারেন। আবার ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক। পশুচিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ভিটামিন সি সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করতে পারেন।
বিড়ালের ফ্লু থেকে বাঁচার উপায়
ফ্লু থেকে আপনার বিড়ালকে সুরক্ষিত রাখতে কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ টিপস দেওয়া হলো:
১) বিড়ালের ফ্লু প্রতিরোধের জন্য ভ্যাকসিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সময়মতো পশুচিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ভ্যাকসিন দিন।
২) আপনার বিড়ালের থাকার জায়গা সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন। নিয়মিত লিটার বক্স পরিষ্কার করুন এবং জীবাণুনাশক ব্যবহার করুন।
৩) বিড়ালকে সবসময় পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর খাবার দিন, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
৪) বিড়ালের স্বাস্থ্য নিয়মিত পরীক্ষা করান। কোনো সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত পশুচিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৫) বিড়ালকে স্ট্রেস থেকে দূরে রাখুন। তাদের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ এবং নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করুন।
৬) নতুন কোনো বিড়াল আনলে তাকে প্রথমে কিছুদিনের জন্য আলাদা রাখুন। এই সময়কালে তার মধ্যে কোনো রোগের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কিনা, তা পর্যবেক্ষণ করুন।
বিড়ালের ফ্লু এবং মানুষের ফ্লু কি একই?
বিড়ালের ফ্লু এবং মানুষের ফ্লু এক নয়। মানুষের ফ্লু হয় ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের কারণে, যা বিড়ালের ফ্লু থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বিড়ালের ফ্লু সাধারণত মানুষের মধ্যে ছড়ায় না, আবার মানুষের ফ্লুও বিড়ালের মধ্যে ছড়ায় না। তবে, কিছু ক্ষেত্রে বিড়ালের ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারে, তাই উভয় ক্ষেত্রেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা জরুরি।
বিড়ালের ফ্লু নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
- প্রশ্ন: বিড়ালের ফ্লু কি মারাত্মক?
সাধারণত, বিড়ালের ফ্লু মারাত্মক নয়। তবে, ছোট বিড়ালের বাচ্চা, বয়স্ক বিড়াল অথবা দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন বিড়ালের জন্য এটি গুরুতর হতে পারে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করালে নিউমোনিয়া হওয়ার ঝুঁকি থাকে, যা প্রাণঘাতী হতে পারে।
- প্রশ্ন: বিড়ালের ফ্লু কতদিন থাকে?
বিড়ালের ফ্লু সাধারণত ১ থেকে ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। তবে, সঠিক চিকিৎসা এবং যত্নের মাধ্যমে এটি দ্রুত সেরে যায়।
- প্রশ্ন: বিড়ালের ফ্লু কি ছোঁয়াচে?
হ্যাঁ, বিড়ালের ফ্লু অত্যন্ত ছোঁয়াচে। আক্রান্ত বিড়ালের হাঁচি, কাশি এবং লালার মাধ্যমে এটি অন্য বিড়ালে ছড়াতে পারে।
- প্রশ্ন: বিড়ালের কি মানুষের ঠান্ডা লাগতে পারে?
সাধারণত নয়, তবে কিছু ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া উভয় প্রজাতিকে প্রভাবিত করতে পারে। যদি আপনার বিড়াল অসুস্থ হয় তবে পশুচিকিত্সকের পরামর্শ নিন।
- প্রশ্ন: আমি কিভাবে বুঝবো বিড়ালের ঠান্ডা লেগেছে?
ঠান্ডার লক্ষণ গুলোর মধ্যে হাঁচি, কাশি, সর্দি, জ্বর এবং অলসতা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
- প্রশ্ন: বিড়ালের ঠান্ডা লাগলে কি করতে হবে?
উষ্ণ এবং আরামদায়ক রাখুন, প্রচুর বিশ্রাম দিন এবং পশুচিকিত্সকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করুন।
- প্রশ্ন: বিড়ালের ঠান্ডা লাগা ও ফ্লুয়ের মধ্যে পার্থক্য কি?
ঠান্ডা সাধারণত হালকা হয় এবং কয়েক দিনের মধ্যে সেরে যায়, যেখানে ফ্লু আরও গুরুতর হতে পারে এবং পশুচিকিত্সকের চিকিৎসার প্রয়োজন হবে
চুড়ান্ত মন্তব্য
বিড়ালের ফ্লু একটি সাধারণ রোগ হলেও সঠিক সময়ে এর চিকিৎসা না করালে এটি মারাত্মক রূপ নিতে পারে। তাই, আপনার বিড়ালের মধ্যে বিড়ালের ফ্লু এর লক্ষণ দেখলে দ্রুত পশুচিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। আপনার একটুখানি সচেতনতা আর ভালোবাসাই পারে আপনার প্রিয় বিড়ালটিকে সুস্থ ও আনন্দিত রাখতে।
তবে যদি আপনার বিড়াল ফ্লুতে আক্রান্ত হয়, তাহলে আতঙ্কিত না হয়ে সঠিক পদক্ষেপ নিন। আপনার যত্ন বিড়ালটিকে দ্রুত সুস্থ করে তুলতে সহায়ক হবে। আপনার বিড়ালের সুস্থ জীবন নিশ্চিত করতে আমাদের আজকের আলোচনা যদি সামান্যতমও কাজে লাগে, তবেই আমাদের প্রচেষ্টা সার্থক হবে।