বিড়াল আমাদের অনেকেরই খুব প্রিয় একটা Pet। কিন্তু এই আদরের বিড়ালছানাটিই যদি জলাতঙ্কের মতো মারাত্মক রোগের শিকার হয়, তবে তা খুবই চিন্তার বিষয়। কেননা, এর কারণে Priyo Pet টাকে চিরকালের জন্য হারিয়ে ফেলতে হবে। শুধু বিড়াল নয়, এই রোগ মানুষের জন্যেও সমান ভয়ের কারণ। তাই, বিড়ালের জলাতঙ্ক নিয়ে সঠিক তথ্য জানা এবং সময় মতো ব্যবস্থা নেওয়া আমাদের সবার দায়িত্ব।
বাংলাদেশে জলাতঙ্ক (Rabies) একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২,০০০ মানুষ এই রোগে মারা যায়। এর প্রধান কারণ হলো সময় মতো টিকা না নেওয়া এবং রোগটি সম্পর্কে অসচেতনতা। বিড়ালের মাধ্যমেও এই রোগ ছড়াতে পারে, তাই বিড়াল মালিকদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।
আজকের এই ব্লগ পোষ্টে আমরা বিড়ালের জলাতঙ্ক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। বিড়ালের জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ গুলো কি কি, এই রোগ কিভাবে ছড়ায়, প্রতিরোধের উপায় এবং আক্রান্ত হলে কি করা উচিত। তাহলে চলুন, শুরু করা যাক।
জলাতঙ্ক রোগ আসলে কি? (What is Rabies?)
জলাতঙ্ক, যা র্যাবিস নামেই বেশি পরিচিত, একটি মারাত্মক ভাইরাসজনিত রোগ। এই রোগ সাধারণত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে দেখা যায় এবং এটি central nervous system-কে আক্রমণ করে। র্যাবিস ভাইরাস (Rabies virus) মূলত লালার মাধ্যমে ছড়ায়।
জলাতঙ্ক কিভাবে ছড়ায়?
র্যাবিস ভাইরাস মূলত সংক্রমিত প্রাণীর লালার মাধ্যমে ছড়ায়। যখন কোনো র্যাবিস আক্রান্ত প্রাণী অন্য কোনো প্রাণীকে কামড়ায় বা আঁচড় দেয়, তখন এই ভাইরাস লালার মাধ্যমে সেই প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করে।
সংক্রমণ প্রক্রিয়াটি কয়েকটি ধাপে ঘটে:
ভাইরাসটি প্রথমে পেশী এবং subcutaneous টিস্যুতে প্রবেশ করে। এরপর এটি peripheral nerves-এর মাধ্যমে central nervous system-এ পৌঁছায়। মস্তিষ্কে পৌঁছানোর পর ভাইরাসটি দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে শুরু করে, যার ফলে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। অবশেষে, ভাইরাসটি লালা গ্রন্থিগুলোতে ছড়িয়ে পরে, যা অন্য প্রাণীদের সংক্রমিত করার জন্য প্রস্তুত থাকে।
র্যাবিস ভাইরাস কিভাবে বিড়ালের শরীরে অ্যাটাক করে?
বিড়ালের শরীরে র্যাবিস ভাইরাস প্রবেশ করার পর, এটি central nervous system-এর দিকে অগ্রসর হয়। ভাইরাসটি মস্তিষ্কে প্রদাহ সৃষ্টি করে, যার ফলে বিড়ালের আচরণে পরিবর্তন আসে এবং অন্যান্য শারীরিক লক্ষণ দেখা দেয়। র্যাবিস ভাইরাস বিড়ালের মস্তিষ্কের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়, যার কারণে বিড়াল স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে না এবং ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়।
অন্যান্য কোন প্রাণীর মাধ্যমেও কি এই রোগ ছড়াতে পারে?
বিড়াল ছাড়াও অন্যান্য অনেক প্রাণীর মাধ্যমে র্যাবিস ছড়াতে পারে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- কুকুর
- শিয়াল
- বাদুড়
- বেজি
- Racoon ইত্যাদি।
সাধারণত, বন্য প্রাণীরাই এই রোগের প্রধান উৎস। তবে, গৃহপালিত পশুদের মধ্যে কুকুর এবং বিড়ালের মাধ্যমেও এই রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি থাকে।
বিড়ালের জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ (Symptoms of Rabies in Cats)
বিড়ালের জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ গুলো সাধারণত তিনটি পর্যায়ে দেখা যায়: প্রাথমিক, মধ্যবর্তী এবং চূড়ান্ত। প্রতিটি পর্যায়ের লক্ষণগুলো ভিন্ন এবং সময়ের সাথে সাথে আরও খারাপ হতে থাকে।
প্রাথমিক লক্ষণ:
জলাতঙ্কের প্রাথমিক পর্যায়ে বিড়ালের মধ্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, যা দেখে আপনি হয়তো প্রথমে বুঝতে নাও পারেন।
১) আচরণের পরিবর্তন: বিড়াল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি চুপচাপ থাকতে পারে, আবার কখনও অতিরিক্ত চঞ্চল হয়ে যেতে পারে। পরিচিত মানুষের প্রতি আগ্রহ কমে যেতে পারে, অথবা অপরিচিতদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হতে পারে।
২) ক্ষুধামন্দা: বিড়ালের খাবারে অরুচি দেখা দিতে পারে। সে হয়তো তার প্রিয় খাবারও খেতে চাইবে না।
৩) জ্বর: হালকা জ্বর থাকতে পারে, যা সবসময় সহজে বোঝা যায় না।
মধ্যবর্তী লক্ষণ:
এই পর্যায়ে লক্ষণগুলো আরও স্পষ্ট হতে শুরু করে এবং রোগটি আরও মারাত্মক রূপ নেয়।
১) অতিরিক্ত লালা ঝরা: বিড়ালের মুখ থেকে অতিরিক্ত লালা ঝরতে পারে এবং মুখ পরিষ্কার করতে না পারার কারণে অসুবিধা হতে পারে।
২) হাইড্রোফোবিয়া (পানির প্রতি ভয়): যদিও এর নাম হাইড্রোফোবিয়া, বিড়াল আসলে পানি পান করতে চায়, কিন্তু গিলতে পারে না। গলার পেশীগুলোতে ব্যাথার কারণে পানি গিলতে অসুবিধা হয়।
৩) আলো এবং শব্দের প্রতি সংবেদনশীলতা: বিড়াল আলো এবং শব্দের প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীল হয়ে ওঠে এবং উজ্জ্বল আলো বা জোরালো শব্দ অপছন্দ করতে শুরু করে।
চূড়ান্ত লক্ষণ:
এটি রোগের শেষ পর্যায়, যখন বিড়ালের শারীরিক অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে থাকে।
১) পেশী দুর্বল হয়ে যাওয়া, প্যারালাইসিস: শরীরের পেশী দুর্বল হয়ে যেতে পারে, বিশেষ করে পা এবং মুখের পেশী। এর ফলে প্যারালাইসিসও হতে পারে।
২) খিঁচুনি: বিড়ালের শরীরে খিঁচুনি হতে পারে, যা খুবই বেদনাদায়ক।
৩) আক্রমণাত্মক হয়ে যাওয়া: বিড়াল অস্বাভাবিকভাবে আক্রমণাত্মক হয়ে যেতে পারে এবং কামড়াতে বা আঁচড়াতে উদ্যত হতে পারে।
লক্ষণ গুলোর পর্যায় এবং সময়কাল
এখানে একটি টেবিল দেওয়া হলো, যেখানে লক্ষণগুলোর পর্যায় এবং সময়কাল উল্লেখ করা হয়েছে:
পর্যায় | লক্ষণ | সময়কাল |
প্রাথমিক | আচরণের পরিবর্তন, ক্ষুধামন্দা, জ্বর | ১-৩ দিন |
মধ্যবর্তী | অতিরিক্ত লালা, হাইড্রোফোবিয়া, সংবেদনশীলতা | ২-৭ দিন |
চূড়ান্ত | প্যারালাইসিস, খিঁচুনি, আক্রমণাত্মক আচরণ | ১-১০ দিন |
যদি আপনার বিড়ালের মধ্যে এই লক্ষণগুলো দেখা যায়, তবে দ্রুত পশুচিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
বিড়ালের মধ্যে র্যাবিস রোগ কিভাবে ছড়ায়? (How Rabies Spreads)
জলাতঙ্ক একটি মারাত্মক রোগ, যা সাধারণত সংক্রমিত প্রাণীর মাধ্যমে ছড়ায়। এই রোগ কিভাবে ছড়ায়, তা জানা থাকলে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়।
- সংক্রমিত প্রাণীর কামড় অথবা আঁচড়ের মাধ্যমে কিভাবে ছড়ায়
জলাতঙ্ক রোগের প্রধান কারণ হলো সংক্রমিত প্রাণীর কামড় অথবা আঁচড়। যখন কোনো র্যাবিস আক্রান্ত প্রাণী অন্য কোনো প্রাণী বা মানুষকে কামড়ায়, তখন তাদের লালার মাধ্যমে র্যাবিস ভাইরাস প্রবেশ করে। আঁচড়ের মাধ্যমেও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে, যদি আঁচড়ের সময় লালা লেগে থাকে।
- লালার মাধ্যমে কিভাবে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে
র্যাবিস ভাইরাস মূলত লালার মাধ্যমে ছড়ায়। সংক্রমিত প্রাণীর লালাতে এই ভাইরাস প্রচুর পরিমাণে থাকে। যখন কোনো সুস্থ প্রাণী বা মানুষ সংক্রমিত প্রাণীর লালার সংস্পর্শে আসে, তখন ভাইরাসটি তাদের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। লালা ছাড়াও, যদি কোনো খোলা ক্ষত বা কাটা স্থানে সংক্রমিত প্রাণীর লালা লাগে, তাহলেও র্যাবিস হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
কোন কোন প্রাণীর মাধ্যমে বিড়ালে এই রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি বেশি
বিড়ালের মধ্যে জলাতঙ্ক ছড়ানোর প্রধান কারণ হলো অন্যান্য সংক্রমিত প্রাণী। কিছু প্রাণী আছে, যাদের মাধ্যমে বিড়ালে এই রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি বেশি। তাদের কয়েকটা নিচে উল্লেখ করা হলো:
- কুকুর: বাংলাদেশে কুকুরের কামড়ের মাধ্যমে জলাতঙ্ক ছড়ানোর ঘটনা বেশি দেখা যায়।
- শিয়াল: গ্রামাঞ্চলে শিয়ালের কামড়ের মাধ্যমেও বিড়াল সংক্রমিত হতে পারে।
- বাদুড়: বাদুড়ের কামড় বা আঁচড়ের মাধ্যমেও র্যাবিস ছড়াতে পারে, তবে এই ঘটনা তুলনামূলকভাবে কম।
যেসব বিড়াল বাড়ির বাইরে যায়, তাদের জলাতঙ্কে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। কারণ তারা অন্যান্য বন্য প্রাণী বা সংক্রমিত প্রাণীর সংস্পর্শে আসার সুযোগ পায়। এছাড়া, বাইরে থাকা বিড়ালদের কুকুরের কামড়ানোর বা আঁচড়ানোর সম্ভাবনাও বেশি থাকে।
উদাহরণ
ধরুন, আপনার পোষা বিড়াল “মিয়াও” একদিন বাইরে ঘুরতে গেল। সেখানে একটি বন্য শিয়াল “মিয়াও”-কে কামড়ালো। শিয়ালটি র্যাবিস ভাইরাসে আক্রান্ত ছিল। কামড়ানোর ফলে শিয়ালের লালা “মিয়াও”-এর শরীরে প্রবেশ করলো এবং “মিয়াও” র্যাবিস দ্বারা সংক্রমিত হলো। কয়েকদিন পর “মিয়াও”-এর মধ্যে জলাতঙ্কের লক্ষণ দেখা যেতে শুরু করলো, যেমন—আচরণের পরিবর্তন, লালা ঝরা এবং পানি খেতে না পারা।
এই উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, কিভাবে একটি সাধারণ ঘটনাও আপনার বিড়ালের জন্য মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। তাই, বিড়ালকে সুরক্ষিত রাখতে হলে তাকে বাড়ির বাইরে যাওয়া থেকে বিরত রাখা উচিত এবং সময় মতো ভ্যাকসিন দেওয়া জরুরি।
বিড়ালকে র্যাবিস রোগ থেকে প্রতিরোধের উপায় (Prevention Methods)
জলাতঙ্ক একটি মারাত্মক রোগ, কিন্তু সঠিক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আপনার বিড়ালকে এই রোগ থেকে রক্ষা করা সম্ভব। প্রতিরোধের প্রধান উপায়গুলো হলো ভ্যাকসিন (টিকা) এবং সচেতনতা।
ভ্যাকসিন (টিকা)
জলাতঙ্কের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকরী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হলো ভ্যাকসিন।
জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন কিভাবে কাজ করে:
জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করে, যা র্যাবিস ভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। যখন কোনো বিড়ালকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়, তখন তার শরীরে একটি নিষ্ক্রিয় বা দুর্বল ভাইরাস প্রবেশ করানো হয়। এর ফলে বিড়ালের immune system সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। পরবর্তীতে, যদি বিড়ালটি র্যাবিস ভাইরাসের সংস্পর্শে আসে, তবে শরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি ভাইরাসটিকে ধ্বংস করে দেয় এবং রোগ প্রতিরোধ করে।
কখন এবং কিভাবে ভ্যাকসিন দিতে হয়:
বিড়ালকে জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন দেওয়ার একটি নির্দিষ্ট সময়সূচী আছে। সাধারণত, বিড়ালছানাদের ৬-৮ সপ্তাহ বয়সে প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া উচিত। এরপর, এক বছর পর বুস্টার ডোজ দিতে হয়। বুস্টার ডোজ দেওয়ার পর, পশুচিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রতি ১-৩ বছর পর পর ভ্যাকসিন দেওয়া উচিত।
ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (যদি থাকে):
জলাতঙ্কের ভ্যাকসিনের তেমন কোনো মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। কিছু বিড়ালের ক্ষেত্রে হালকা জ্বর, ইঞ্জেকশন দেওয়ার স্থানে সামান্য ফোলাভাব বা ব্যথা হতে পারে, যা কয়েক দিনের মধ্যে সেরে যায়। তবে, যদি কোনো গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়, তবে দ্রুত পশুচিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
সচেতনতা:
ভ্যাকসিনের পাশাপাশি সচেতনতাও জলাতঙ্ক প্রতিরোধের জন্য জরুরি।
- বিড়ালকে বাড়ির বাইরে কম যেতে দেওয়া: বিড়ালকে বাড়ির বাইরে কম যেতে দিলে অন্যান্য সংক্রমিত প্রাণীর সংস্পর্শে আসার ঝুঁকি কমে যায়।
- অন্যান্য প্রাণী থেকে দূরে রাখা: আপনার বিড়ালকে অন্যান্য বন্য প্রাণী বা অপরিচিত বিড়াল থেকে দূরে রাখুন।
- নিয়মিত পশুচিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া: নিয়মিত পশুচিকিৎসকের কাছে গিয়ে আপনার বিড়ালের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান এবং তার পরামর্শ অনুযায়ী চলুন।
ভ্যাকসিনের সময়সূচী:
এখানে একটি টেবিল দেওয়া হলো, যেখানে ভ্যাকসিনের সময়সূচী উল্লেখ করা হয়েছে:
ভ্যাকসিনের নাম | প্রথম ডোজ | বুস্টার ডোজ | প্রতিষেধকের সময়কাল |
র্যাবিস ভ্যাকসিন | ৬-৮ সপ্তাহ বয়সে | ১ বছর পর | ১-৩ বছর (পশুচিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী) |
এই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলো অনুসরণ করে আপনি আপনার বিড়ালকে জলাতঙ্কের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন।
বিড়াল ইতিমধ্যেই র্যাবিস ভাইরাসে আক্রান্ত হলে কি করবেন? (What to do if Infected?)
যদি কোনো বিড়াল জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়, তবে দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
- বিড়ালকে কামড় বা আঁচড় দিলে দ্রুত কি করা উচিত?
যদি কোনো র্যাবিস আক্রান্ত বিড়াল আপনাকে কামড়ায় বা আঁচড়ায়, তবে দ্রুত নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নিন। প্রথমে ক্ষত স্থানটি সাবান ও জল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিন। কমপক্ষে ১৫ মিনিট ধরে ধুতে থাকুন। ক্ষত স্থান ধোয়ার পর একটি জীবাণুনাশক (antiseptic) যেমন—পভিডন আয়োডিন (Povidone-iodine) বা অ্যালকোহল ব্যবহার করুন। দ্রুত ডাক্তারের কাছে যান এবং আপনার পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানান।
- তাৎক্ষণিকভাবে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া এবং টিটেনাস ইনজেকশন নেওয়া
জলাতঙ্কের সংক্রমণ মারাত্মক হতে পারে, তাই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া খুবই জরুরি। ডাক্তার আপনাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেবেন এবং টিটেনাস ইনজেকশন (tetanus injection) দেওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন, যদি আপনার আগে টিটেনাস টিকা নেওয়া না থাকে। এছাড়াও, ডাক্তার র্যাবিস ভ্যাকসিন এবং ইমিউনোগ্লোবুলিন (immunoglobulin) দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যা র্যাবিস ভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে সাহায্য করবে।
- বিড়ালকে পর্যবেক্ষণে রাখা এবং পশুচিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া
যদি আপনার বিড়াল অন্য কোনো প্রাণী বা মানুষকে কামড়ায়, তবে বিড়ালটিকে পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত। পশুচিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী, বিড়ালটিকে কোয়ারেন্টিনে (quarantine) রাখতে হতে পারে এবং তার মধ্যে জলাতঙ্কের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কিনা, তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। যদি বিড়ালটি জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে থাকে, তবে পশুচিকিৎসক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
বিড়াল কামড়ালে মানুষের ক্ষেত্রে র্যাবিসের চিকিৎসা পদ্ধতি
মানুষের ক্ষেত্রে জলাতঙ্কের চিকিৎসা মূলত পোস্ট-এক্সপোজার প্রোফিল্যাক্সিস (Post-exposure prophylaxis, PEP) এর মাধ্যমে করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে:
- ক্ষত স্থানের চিকিৎসা: কামড়ের স্থান সাবান ও জল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে জীবাণুনাশক ব্যবহার করা।
- র্যাবিস ভ্যাকসিন: আক্রান্ত ব্যক্তিকে র্যাবিস ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। সাধারণত, এই ভ্যাকসিন কয়েক ডোজে দেওয়া হয় (যেমন—০, ৩, ৭ এবং ১৪ দিনে)।
- র্যাবিস ইমিউনোগ্লোবুলিন (RIG): যদি আক্রান্ত ব্যক্তির আগে র্যাবিস ভ্যাকসিন নেওয়া না থাকে, তবে র্যাবিস ইমিউনোগ্লোবুলিন দেওয়া হয়। এটি সরাসরি র্যাবিস ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে এবং দ্রুত সুরক্ষা প্রদান করে।
মনে রাখবেন, জলাতঙ্ক একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ, কিন্তু একবার লক্ষণ দেখা দিলে এটি মারাত্মক হতে পারে। তাই, দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা জীবন বাঁচাতে পারে।
ভুল ধারণা এবং বাস্তবতা (Myths and Facts)
জলাতঙ্ক নিয়ে সমাজে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। এই ভুল ধারণাগুলোর কারণে মানুষ সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারে না। তাই, কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা এবং এর পেছনের বাস্তবতাগুলো তুলে ধরা হলো:
১ম ভুল ধারণা: শুধু পাগল কুকুর বা বিড়ালের কামড়েই জলাতঙ্ক হয়।
বাস্তবতা: জলাতঙ্ক যে কোনো সংক্রমিত স্তন্যপায়ী প্রাণীর কামড় বা আঁচড়ের মাধ্যমে ছড়াতে পারে, শুধু পাগল কুকুরের কামড়ে নয়। এমনকি, আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ প্রাণীর লালা থেকেও এই রোগ ছড়াতে পারে, যদি সেই প্রাণীটি র্যাবিস ভাইরাসে আক্রান্ত থাকে।
২য় ভুল ধারণা: জলাতঙ্ক শুধু গ্রীষ্মকালেই হয়।
বাস্তবতা: জলাতঙ্ক যে কোনো সময়ে হতে পারে। গ্রীষ্মকালে কুকুরের প্রজননকাল হওয়ায় তাদের মধ্যে কামড়ানোর প্রবণতা বাড়ে, তাই এই সময় ঝুঁকি কিছুটা বেশি থাকে। তবে, এর মানে এই নয় যে অন্য সময়ে এই রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা নেই।
৩য় ভুল ধারণা: কামড়ের পর লক্ষণ দেখা দিলেই কেবল চিকিৎসা শুরু করা উচিত।
বাস্তবতা: জলাতঙ্কের লক্ষণ দেখা দেওয়ার আগেই চিকিৎসা শুরু করা উচিত। লক্ষণ দেখা দেওয়ার পরে চিকিৎসা করালেও অনেক সময় জীবন বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। কামড় বা আঁচড়ের পরপরই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
৪র্থ ভুল ধারণা: একবার র্যাবিস ভ্যাকসিন নিলে আর কোনো টিকার প্রয়োজন নেই।
বাস্তবতা: র্যাবিস ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা সময়ের সাথে সাথে কমে যায়। তাই, পশুচিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পর পর বুস্টার ডোজ নেওয়া জরুরি।
৫ম ভুল ধারণা: বিড়ালকে সবসময় ঘরের ভেতরে রাখলে জলাতঙ্কের ঝুঁকি নেই।
বাস্তবতা: যদিও বিড়ালকে ঘরের ভেতরে রাখলে ঝুঁকি কমে যায়, তবুও একেবারে ঝুঁকি থাকে না। কারণ, বাদুড় বা অন্য কোনো সংক্রমিত প্রাণী ঘরে ঢুকে বিড়ালকে কামড়াতে পারে। তাই, বিড়ালকে সুরক্ষিত রাখতে ভ্যাকসিন দেওয়া জরুরি।
উপসংহার (Conclusion)
জলাতঙ্ক একটি অত্যন্ত মারাত্মক রোগ, যা প্রতিরোধযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও প্রতি বছর বহু মানুষ ও প্রাণী এর শিকার হয়। এই রোগের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে আমাদের সবার উচিত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং সময় মতো সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া।
সচেতন থাকার মাধ্যমে এবং সময় মতো ভ্যাকসিন দেওয়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রিয় বিড়াল এবং নিজেদের জীবন বাঁচাতে পারি। মনে রাখবেন, একটুখানি সতর্কতা এবং সচেতনতাই পারে একটি জীবনকে সুরক্ষিত করতে। তাই, অবহেলা না করে বিড়ালের জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ দেখা শুরু হওয়ার আগেই আপনার বিড়ালকে র্যাবিস ভ্যাকসিন দিন এবং আমাদের সমাজকে জলাতঙ্কমুক্ত করতে সাহায্য করুন। আপনার সচেতনতাই পারে একটি সুস্থ ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়তে।